
রামগতিতে ৫১ ইটভাটার সবগুলোই ফসলের জমিতে !
তাবারক হোসেন আজাদ, লক্ষ্মীপুরঃ
বর্ষা মৌসুম শেষ না হতেই শুরু হয়ে গেছে শ্রমিকদের ইট উৎপাদনের ব্যস্ততা। ইট তৈরি, নতুন ভাটা নির্মাণ, শ্রমিক নিয়োগ, মাটি কেনা -বেচা—সব মিলিয়ে এখন চলছে তোড়জোড়। তবে এসবে আইন মানছেন না কোনো মালিক।
লক্ষ্মীপুরের রামগতি উপজেলায় দুটি ভাটার অনুমোদন থাকলেও চলছে ৫১টি। সবগুলোর অবস্থানই ফসলি জমিতে।
অবৈধ ভাটা বন্ধ করতে গত বছর নির্দেশনা দিয়েছিলেন উচ্চ আদালত। তবে এ আদেশ বাস্তবায়ন করতে পারেনি পরিবেশ অধিদপ্তর ও উপজেলা প্রশাসন। উল্টো এ আদেশের পর চলতি বছর আরও দুটি ইটভাটা এ উপজেলায় নির্মাণ করা হয়েছে।
পরিবেশ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালে রামগতিতে ইটভাটা ছিল ৪০টি। ২০২৪ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৪৯টিতে। চলতি বছর আরও দুটি বাড়ায় বর্তমানে ৫১টি ইটভাটা রয়েছে। এর মধ্যে রামগতির চর রমিজ ইউনিয়নেই রয়েছে ৪০টি ইটভাটা।
স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, প্রতিবছরই এসব অবৈধ ইটভাটা বন্ধে লোক দেখানো অভিযান চালায় প্রশাসন। কিন্তু এ অভিযানে কোনো ভাটা বন্ধ হয় না। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সাময়িক জরিমানা করে প্রশাসন চলে যায়। যাওয়ার পরপরই আবার পুরোদমে ইটভাটার কার্যক্রম শুরু হয়। কার্যকর অভিযান থাকলে অবৈধইটভাটা স্থাপনে মালিকেরা নিরুৎসাহিত।
চর আফজল গ্রামের কৃষক মাইনুদ্দিন বলেন, গ্রামে একসময় ছিলো ধান ও সবজির জমি। এখন সেখানে সারি সারি ইটভাটা। জমির মাটি কেটে নেওয়ায় ফসল উৎপাদন কমে যাচ্ছে।
ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন (নিয়ন্ত্রণ) আইন অনুযায়ী, লোকালয়, কৃষিজমি ও টিলার নির্দিষ্ট দূরত্বে ইটভাটা স্থাপন নিষিদ্ধ। কৃষিজমির মাটি দিয়ে ইট তৈরিতেও নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। আইনের ৫ (১) ধারায় উল্লেখ করা হয়েছে—ইট তৈরির জন্য পাহাড়, টিলা ও কৃষিজমি থেকে মাটি নেওয়া যাবে না। এ আইন লঙ্ঘন করলে সর্বোচ্চ দুই বছরের কারাদণ্ড, দুই লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ড হতে পারে। তবে এসব আইন শুধু কাগজে-কলমেই।
রামগতি উপজেলার ভাটার মালিকদের কেউ এ আইন মানছেন না। সব ভাটার আশপাশেই রয়েছে মানুষের বসতবাড়ি ও কৃষিজমি। স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ তাঁরা এসব ভাটা বন্ধের দাবিতে একাধিকবার মানববন্ধন করেছেন। উপজেলা প্রশাসনকেও লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন। তবে মালিকদের প্রভাবে কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এ কারণে প্রশাসনের নাগের ডগায় এসব ইটভাটা গড়ে উঠছে। এসব ইটভাটা নিয়ে গত বছর ৫ ডিসেম্বর ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানও ক্ষোভ প্রকাশ করেন।
সরেজমিন বুধবার (৫ নভেম্বার) চর আফজল, চর মেহার, চর আলগী ও চর পোড়াগাছা এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, ভাটাগুলোতে ইটের ছাঁচ তৈরি, চুল্লি সংস্কার, শ্রমিক নিয়োগ ও কাঠ-কয়লার মজুতের কাজ চলছে। কিছু ভাটায় কাঁচা ইট তৈরির কাজও শেষ পর্যায়ে। এখন শুধু আগুন জ্বালানোর অপেক্ষা।
জানতে চাইলে রামগতির একটি ইটভাটার শ্রমিক বলেন, ‘ইটভাটাগুলোতে কাজ শুরু হয় অক্টোবরের শুরুতে। এখন পুরোদমে কাজ চলছে। চলতি সপ্তাহে ইট পোড়ানো শুরু হবে।’
পরিবেশ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালে রামগতিতে ইটভাটা ছিল ৪০টি। ২০২৪ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৪৯টিতে। চলতি বছর আরও দুটি বাড়ায় বর্তমানে ৫১টি ইটভাটা রয়েছে। রামগতির চর রমিজ ইউনিয়নেই রয়েছে ৪০টি ইটভাটা।
স্থানীয় চর আফজল গ্রামের কৃষক নুরুল আলম ও মালেক হোসেন বলেন, গ্রামে একসময় ছিল ধান ও সবজির জমি। এখন সেখানে সারি সারি ইটভাটা। জমির মাটি কেটে নেওয়ায় ফসল উৎপাদন কমে যাচ্ছে। কারণ খেতে আর কাদা জমছে না।
একই এলাকার কৃষক করিম গাজি বলেন, চর রমিজ ইউনিয়নে ৪০টি ইটভাটা। ভাটার কারণে সাত মাস (নভেম্বর থেকে মে) লোকজন চরম দুর্ভোগে বসবাস করেন। ভাটার ধোঁয়ায় বাতাস দূষিত হয়ে যায়। গত ছয় বছর ধরে তাঁর গলায় চর্মরোগ দেখা দেয়। অনেক ডাক্তার দেখিয়েছে, কিন্তু কাজ হচ্ছে না। বর্ষা মৌসুমে ভাটা বন্ধ থাকলে তাঁর চর্মরোগ কিছুটা কমে যায়।
গত বছর রামগতি ও কমলনগর উপজেলার সব অবৈধ ইটভাটা বন্ধে হাইকোর্টে রিটকারী জ্যেষ্ঠ আইনজীবী সালাহ উদ্দিন বলেন, ‘রামগতির ৪৮ ও কমলনগরের ১০টি অবৈধ ইটভাটা বন্ধের নির্দেশ চেয়েছিলাম। আদালত চলতি বছর ৪ মার্চ সেই নির্দেশ দেন, কিন্তু প্রশাসন এখনো তা বাস্তবায়ন করেনি।’
রামগতি ইটভাটা মালিক সমিতির সভাপতি খলিল উল্যাহ বলেন, ‘ভাটাগুলো অনেক আগেই তৈরি হয়েছিল। তখন এ গ্রামে বসতি ছিল না। এখন সবাই ছাড়পত্র পাওয়ার জন্য আবেদন করেছেন; কিন্তু ছাড়পত্র পাননি।’
লক্ষ্মীপুর পরিবেশ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক হারুন অর রশিদ বলেন, রামগতির এসব ইটভাটা বন্ধে তাঁরা কাজ শুরু করেছেন। ইতিমধ্যে অভিযানও চালান। আবার চালাবেন।
রামগতি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সৈয়দ আমজাদ হোসেন বলেন, ‘গত বছর হাইকোর্টের নির্দেশে কয়েকটি ভাটা ভেঙে দিয়েছিলাম। মালিকেরা আবার মেরামত করে চালু করেছেন। এ বছর ভাটা বন্ধে আগস্টে মাইকিং করা হয়। আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার প্রচারও চালানো হয়। তাঁরা দ্রুত অভিযান চালাবেন।’