‘শাসন’ ও শ্রমিকের হাহাকার- রংপুর শ্রম দপ্তরে ঘুষের গন্ধে দমবন্ধ

অর্থনীতি আইন আদালত রংপুর রাজনীতি সারাদেশ
শেয়ার করুন....,

‘শাসন’ ও শ্রমিকের হাহাকার-

রংপুর শ্রম দপ্তরে ঘুষের গন্ধে দমবন্ধ

মোস্তাক আহমেদ বাবু, রংপুরঃ

 

রংপুরের আরকে রোডের নিচতলায় একটি নামফলক—“আঞ্চলিক শ্রম দপ্তর, রংপুর।” কিন্তু দরজা পেরোলেই বোঝা যায়, এটি কেবল সরকারি অফিস নয়, এক অঘোষিত ‘রাজ্যের’ নাম। এখানে ফাইলের শব্দ নেই, আছে কাগজের নিচে ঘুষের খসখসানি। আর কেন্দ্রে আছেন এক অফিস সহকারী—ছাবদার হোসেন, যার টেবিল থেকে নির্ধারিত হয় শ্রমিক ইউনিয়নের নির্বাচন, কমিটি, পরিচয়পত্র—এমনকি কোন অভিযোগ ‘হারিয়ে’ যাবে।

ঘটনার ক্রমরেখা: ইউনিয়নের নির্বাচন থেকে প্রশাসনিক নিষ্ক্রিয়তা

নির্বাচনের নামে ‘নাটক’

রংপুর জেলা ট্রাক ও ট্যাংক লরি শ্রমিক ইউনিয়নের (রেজি. নং রাজ–৯২১) সাধারণ সভা আহ্বান হয় ২ জানুয়ারি ২০২৫।
প্রবীণ শ্রমিকরা অভিযোগ করেন: ভোটার তালিকায় ভুয়া সদস্য, বহিরাগত ও দ্বৈত ভোটার, কোনো যাচাই ছাড়া কমিটি গঠন।

তবুও নির্বাচন হয়। পরবর্তীতে শ্রম দপ্তর জানায়—সভায় কোরাম হয়নি, অনেকেই প্রকৃত শ্রমিক ছিলেন না। ফলে ফলাফল বাতিল করে ৩০ দিনের মধ্যে পুনঃনির্বাচনের নির্দেশ দেয়।

আদালতের মামলা, নাকি অজুহাত ?

কমিটি আদালতের শরণাপন্ন হয়। অথচ আদালতের পক্ষ থেকে কোনো স্থগিতাদেশই আসেনি।
তবুও দপ্তর নীরব।

আর উপপরিচালক তুষার কান্তি বলেন, “কোর্টে মামলা আছে, তাই কিছুই করার নেই।”

কিন্তু যখন জানানো হয় যে আদালতের নিষেধাজ্ঞা নেই, তখন তিনি চুপ করে যান।

পেছনের কুশীলব: অফিস সহকারী ছাবদার হোসেন

দপ্তরের অভ্যন্তরীণ সূত্র বলছে—“ছাবদার যা বলে, সেটাই ফাইনাল। উপপরিচালক কাগজে সই করেন, কিন্তু নির্দেশ আসে ছাবদারের মুখে।”

তিনি শুধু অফিস ফাইল নয়, ইউনিয়নের ভবিষ্যৎও ‘ম্যানেজ’ করেন—কমিটি অনুমোদন থেকে শুরু করে নির্বাচনী ফলাফল গায়েব করা পর্যন্ত।

কো-অপট কমিটি: ঘুষের গন্ধে গঠিত এক ছায়া-শাসন
অভিযোগ:

কুড়িগ্রাম জেলা অটো টেম্পু ও সিএনজি শ্রমিক ইউনিয়নে মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটির জায়গায় গঠিত হয় এক রহস্যময় ‘কো-অপট কমিটি’।

ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক বলেন, “ছাবদারের পাশে বসে আমাদের দুজন সদস্যকে ‘রেডি করা’ রেজুলেশনে সই করানো হয়। পরে শুনি, ৮০ হাজার টাকায় কমিটি অনুমোদন পেয়েছে।”

কমিটি গঠনের কথা স্বীকার করলেও, ঘুষের কথা অস্বীকার করে সংশ্লিষ্টরা।

বিশ্লেষণ: একটি দপ্তর, একটি সহকারী, একচ্ছত্র রাজত্ব

ক্ষেত্র বাস্তবতা

প্রশাসনিক কাঠামো নিয়মের বাইরে চলা মৌখিক আদেশ দুর্নীতি ঘুষের বিনিময়ে কমিটি অনুমোদন শ্রমিক অধিকার প্রতিনিধিত্বহীনতা, ভোটের অধিকার খর্ব দপ্তরের বিশ্বাসযোগ্যতা চরমভাবে প্রশ্নবিদ্ধ।

একজন কর্মকর্তা স্পষ্টভাবে বলেই ফেলেন— “ছাবদারকে নিয়ন্ত্রণে আমি ব্যর্থ, এটা ঠিক নয়।”
এই বক্তব্যই যথেষ্ট প্রমাণ, কে চালাচ্ছেন অফিসটা।

শ্রমিকদের কণ্ঠে ক্ষোভ:

একজন প্রবীণ ট্রাক চালক বলেন—“আমরা রাতে গাড়িতে ঘুমাই, দিনের বেলা তেল-ধোঁয়ায় কাজ করি। ইউনিয়নের অফিসে গেলে মনে হয়, আমরা শুধু ভোটের সময়ই মানুষ। বাকি সময় কাগজে বন্দি।”

সম্ভাব্য ফলাফল: প্রকৃত শ্রমিকরা হারাবেন প্রতিনিধি হওয়ার অধিকার, ইউনিয়নের ভিতরে ভাঙন, অবিশ্বাস, দপ্তর হয়ে উঠবে ঘুষের বাজার, অন্যান্য অঞ্চলেও এই সংস্কৃতি ছড়িয়ে পড়বে।

পথ খোঁজা: কী করণীয়?

🔹 ছাবদার হোসেনের বিরুদ্ধে বিভাগীয় তদন্ত ও সাময়িক বরখাস্ত, উপপরিচালকের দায়িত্বহীনতার তদন্ত ও ব্যাখ্যা দাবি, আদালতের আদেশ স্পষ্ট করে পুনঃনির্বাচনের আয়োজন, ফেইক ভোটার তালিকা বাতিল ও হালনাগাদ সদস্য তালিকা প্রকাশ, শ্রমিকদের অধিকার ও দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতনতামূলক কার্যক্রম, সংবাদমাধ্যম ও সুশীল সমাজের সক্রিয়তা নিশ্চিত করা।

উপসংহার:

রংপুর শ্রম দপ্তরের ঘটনা একটি ‘লোকাল ইস্যু’ নয়। এটি বাংলাদেশের শ্রম প্রশাসনের একটি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়া চিত্র—যেখানে একজন অফিস সহকারীর ইচ্ছা আইন হয়ে দাঁড়ায়, আর শ্রমিকের ঘাম হারিয়ে যায় ফাইলের পাতায়।

যদি এখনই এই দুর্নীতির শেকড় কাটা না হয়—এটা ছড়িয়ে পড়বে আরও দশটি দপ্তরে, আরও হাজারো শ্রমিকের ভবিষ্যৎ গ্রাস করবে। এখনই সময় ‘ছাবদার-নীতি’কে ভাঙার।

শেষ কথা:
একজন প্রখ্যাত সাংবাদিক একবার বলে ছিলেন— “সত্যকে কিছু সময় চাপা দেওয়া যায়, কিন্তু শেষমেশ সত্যই আলো ফোটায়।”রংপুরের শ্রম দপ্তরে এখন সত্য প্রকাশ পাচ্ছে ঘুষের ধোঁয়ার ফাঁক দিয়ে।


শেয়ার করুন....,

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *