
কুমিল্লা বিভাগ বাস্তবায়ন করে
রাষ্ট্রকেই বরং ঋণ শোধ করতে হবে
শাহাজাদা এমরান।।
বাংলাদেশের একজন নাগরিক হিসেবে আজ নিজেকে নিজেই ধিক্কার দিচ্ছি— এজন্য যে, স্বাধীনতার ৫৪ বছর পরেও কুমিল্লার মতো একটি প্রাচীন, সমৃদ্ধ, বৃহৎ জেলাকে বিভাগ ঘোষণার জন্য সরকারের কাছে দাবি জানাতে হচ্ছে। এর চেয়ে লজ্জাজনক, হীনমন্যতাপূর্ণ, দুঃখজনক, বেদনাদায়ক ঘটনা দেশে আর আছে কিনা, আমার জানা নেই।
আজ অনেকটা ভারাক্রান্ত হৃদয় নিয়ে, কিছুটা বিক্ষুব্ধ হয়ে লিখতে বসেছি, একটি যৌক্তিক কথা বলার জন্য। সেটা হলো— কুমিল্লা বিভাগ কুমিল্লা নামেই বাস্তবায়ন করতে হবে। এর আগে রাষ্ট্রকে দু:খ প্রকাশ করতে হবে দেশ স্বাধীনের ৫৪ বছর পরেও কেন কুমিল্লা বিভাগ এর জন্য আন্দোলন করতে হচ্ছে, রাষ্ট্রের কাছে চাইতে হচ্ছে। যেখানে কুমিল্লার নাতি পুতির সমান সিলেট, ময়মনসিং ও বরিশাল বিভাগ হচ্ছে সেখানে দাদার বয়সী কুমিল্লাকে কেন বার বার এ দাবির জন্য রাজপথে নেমে আসতে হচ্ছে।
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বাংলাদেশে ১৯টি জেলা এবং ৪টি বিভাগ ছিল। তখন থেকেই কথা চলছিল যে, দেশের পরবর্তী বিভাগ হলে সেটি হবে কুমিল্লা। কারণ, দেশের অর্থনৈতিক, ভৌগোলিক অবস্থান ও প্রাচীন স্থাপত্যের নিদর্শন, শিক্ষা, বিজ্ঞান, কৃষি, আয়তন, জনসংখ্যা,অবকাঠামোসহ সব দিক দিয়েই এগিয়ে থাকা একটি জেলা হচ্ছে কুমিল্লা। প্রাচীন সভ্যতার মিলনস্থল হচ্ছে কুমিল্লা; সমতটের রাজধানী ছিল কুমিল্লা।
কিন্তু দুঃখজনকভাবে বলতে হয়, গত ৫৪ বছরে দেশে আরও ৪ টি বিভাগ হয়েছে। কিন্ত এ ক্ষেত্রে বার বার উপেক্ষিত হচ্ছে কুমিল্লা।অথচ ঐ চারটি নতুন বিভাগে যখন শিক্ষা বোর্ডও ছিল না ,তখনো কিন্তু কুমিল্লা শিক্ষা বোর্ড ছিল। এক সময় পুরো চট্রগ্রাম ও সিলেট বিভাগ কুমিল্লা শিক্ষা বোর্ডের অধীন ছিল।
কুমিল্লার অতীত রাজনৈতিক ব্যক্তিদের কমিটমেন্টের অভাবে এবং কুমিল্লার প্রতি তাদের চরম উদাসীনতার কারণেই কুমিল্লা বিভাগ এখনো হয়নি। নতুবা দেশের পঞ্চম নম্বর বিভাগই হতো কুমিল্লা। আজ কুমিল্লাকে নবম নম্বর বিভাগের জন্য রাজপথে নামতে হচ্ছে , এটা সত্যিই দূর্ভাগ্যজনক বিষয়। বাংলাদেশের সকল রাজনৈতিক দলই কুমিল্লাকে বিভাগ মেনে নিয়েই তাদের কুমিল্লা বিভাগীয় রাজনৈতিক কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে ২০১০ সালের পর থেকেই । এমন কোনো রাজনৈতিক বড় নেতা নেই, যিনি কুমিল্লাকে বিভাগ হিসেবে মেনে নিয়ে এখানে এসে দলীয় কার্যক্রম করেননি।
অথচ দুঃখের বিষয় হলো— বিএনপির কুমিল্লা বিভাগীয় দায়িত্বে থাকা বিএনপির কেন্দ্রীয় ভাইস চেয়ারম্যান বরকত উল্লাহ বুলু কিছুদিন আগে তাঁর ফেসবুকে এক পোস্টে নোয়াখালীকে বিভাগ দেয়ার দাবি করেছেন। আমার কথা হচ্ছে, নোয়াখালীর সন্তান হিসেবে আপনি সেটা চাইতেই পারেন— কিন্তু তার পূর্বে আপনি কুমিল্লা বিভাগীয় দায়িত্ব থেকে পদত্যাগ করেননি কেন? আপনার লজ্জা হওয়া উচিত, বুলু সাহেব। সামনে নির্বাচনকে সামনে রেখে সস্তা জনপ্রিয়তা অর্জনের জন্য বক্তব্য দেওয়া থেকে বিরত থাকুন। আপনি পরবর্তীতে নোয়াখালীকে বিভাগ চাওয়ার আগে কুমিল্লা বিভাগীয় পদ থেকে ইস্তফা দেবেন। নতুবা জনগণ আপনাকে “ডাবল স্ট্যান্ডার্ড” নেতা হিসেবে প্রত্যাখ্যান করতে বাধ্য হবে।
আজ যখন কুমিল্লা বিভাগ ঘোষণার বিষয়ে সিদ্ধান্তের সময় এসেছে, তখন কুমিল্লার প্রাচীনতম একটি অংশ এর বিরোধিতা করছে— সেটি হচ্ছে নোয়াখালী। নোয়াখালী বিভাগ কিংবা রাজধানী চাইলেও একজন নাগরিক হিসেবে আমার কোনো আপত্তি নেই। কারণ, দেশের নীতিনির্ধারকরা যদি নোয়াখালীকে সক্ষম মনে করেন, তাহলে তারা সেটা করবেন ।কিন্তু কুমিল্লা বিভাগের তারা বিরোধীতা করবেন কেন ?
কিন্তু কুমিল্লার মতো একটি জেলাকে বিভাগ করা যাবে না— এর বিপক্ষে নোয়াখালী যে অবস্থান নিয়েছে, আমি তার প্রতিবাদ করছি মাত্র । আমি আজকের এই লেখায় সুনির্দিষ্ট ভাবে ৬টি বিষয় উল্লেখ করব কি কারণে বিভাগীয় শহরের মর্যাদা হিসেবে নোয়াখালী থেকে কুমিল্লা যোজন যোজন এগিয়ে। সেখানে নোয়াখালী যদি নূন্যতম কুমিল্লার ধারে কাছেও কোন নম্বর পায় তাহলে আমি প্রকাশ্যে ক্ষমা চাইব।
যেই ছয়টি কারণে কুমিল্লা নামেই বিভাগ এবং নোয়াখালীকেও কুমিল্লা বিভাগের আওতায় আসতে হবে , সেটি আমি ক্রমান্বয়ে নিচে উল্লেখ করছি।
প্রথমত, ভৌগোলিকভাবে দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের মূল কেন্দ্র হচ্ছে কুমিল্লা। এখান থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া, ফেনী, চাঁদপুর, লক্ষ্মীপুর ও নোয়াখালীতে সহজে যাতায়াত করা যায়। কিন্তু নোয়াখালী একটি প্রান্তে অবস্থিত হওয়ায় সেটা সম্ভব নয়। বিভাগীয় কার্যালয় হতে হবে কেন্দ্রবিন্দুতে,যাতে জনগনের যাতায়াত অত্যন্ত সহজ হয়।
আরেকটি কথা না বললেই নয়— কুমিল্লায় ৩৪টি সরকারি অফিস রয়েছে। এই ৩৪টি অফিসের হেড প্রধান কার্যালয় কুমিল্লা। আর জেলা কার্যালয় নোয়াখালী। তারা তাদের হেড অফিসের কার্যক্রম কুমিল্লাতেই সম্পন্ন করে। বর্তমানে আপনারা চট্টগ্রাম যান শুধু বিভাগীয় কাজের জন্য। অথচ কুমিল্লা বিভাগ হলে আপনারা এক কাজে কুমিল্লা এলে অন্য কাজটিও করে যেতে পারবেন।
দ্বিতীয়ত, কুমিল্লায় বিভাগীয় কার্যক্রমের জন্য অবকাঠামোগত প্রস্তুতি সম্পূর্ণ আছে। কুমিল্লা একটি বিভাগ হওয়ার জন্য যতটুকু অবকাঠামো দরকার, সবই প্রস্তুত। যা নোয়াখালীতে দশ শতাংসও নেই। মেডিকেল কলেজ, হাইওয়ে পুলিশ, বিশ্ববিদ্যালয়সহ সবকিছুই এখানে রয়েছে। যার মাধ্যমে এখনই ঘোষণা দিয়ে সকল বিভাগীয় কার্যক্রম পরিচালনা করা সম্ভব।
আর যদি নোয়াখালী বিভাগ ঘোষণা করা হয়, তাহলে নতুন করে সব কিছু করতে হবে, একনেকে পাশ করাতে হবে, অবকাঠামোগত প্রস্তুতি নিতে হবে— তারপর ঘোষণা করতে হবে।
তৃতীয়ত, কুমিল্লার অর্থনৈতিক গুরুত্ব অনেক। এটি একটি শিল্প ও বাণিজ্যিক কেন্দ্র। এখানকার ইপিজেড অন্যান্য জেলার তুলনায় অনেক এগিয়ে, যা নোয়াখালীতে নেই। ময়নামতি, শালবন বিহার, ওয়্যার সেমেট্রিসহ নানা ঐতিহ্য কুমিল্লাকে আরও সমৃদ্ধ করেছে।
চতুর্থত, কুমিল্লার জনসংখ্যা ও দক্ষ জনবল বিভাগীয় প্রশাসন পরিচালনায় প্রস্তুত। গেল সপ্তাহে “Face the People” এর এক সাক্ষাৎকারে এক নোয়াখালী ভাই বলছিলেন, তাদের তিন জেলা মিলিয়ে নাকি এক কোটি জনগণ আছে। অথচ শুধু কুমিল্লাতেই প্রায় এক কোটি জনসংখ্যা রয়েছে।
পঞ্চমত,কুমিল্লা একটি প্রাচীন জনপদ। ময়নামতি সভ্যতা,বৌদ্ধ ঐতিহ্য ,মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস-সব মিলিয়ে এটি একটি ঐতিহ্যবাহী এলাকা। নিজস্ব ঐতিহ্য ও পরিচয়ের কারণে কুমিল্লা আলাদা বিভাগ হিসেবে গড়ে উঠার যোগ্যতা রাখে।
ষষ্ঠত্ব, “কুমিল্লা বিভাগ চাই”— এটি আজকের দাবি নয়, আশির দশকের দাবি। নব্বইয়ের দশকে যখন আন্দোলন হয়, তখন আপনাদেরও অনেকেই সেই দাবির সঙ্গে একমত ছিলেন।
আমরা বলতে চাই— কুমিল্লা সবার জন্য যাতায়াতে সহজ এবং কৌশলগতভাবে কুমিল্লা বিভাগের পূর্ণ অধিকার রাখে। কুমিল্লার মানুষকে কোনো দয়া করে বিভাগ দিতে হবে না; তারা বিভাগের দাবিদার।
যেকোনো বিবেচনায় সিলেট, ময়মনসিংহ, রংপুর থেকে কুমিল্লা সবদিক দিয়ে এগিয়ে। তারপরও কুমিল্লা বিভাগের জন্য কেন দাবি করতে হচ্ছে— দায়িত্বপ্রাপ্তদের উচিত ক্ষমা চেয়ে কুমিল্লাকে বিভাগ ঘোষণা করা। এটা দয়ার নয়, অধিকারের বিষয়।
সরকারকে কুমিল্লা নামে বিভাগ দিয়ে কুমিল্লাবাসীর প্রতি তাদের ঋণ শোধ করতে হবে।
গত সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কুমিল্লাকে নানা কটুক্তি করেছেন। কুমিল্লার মানুষের সঙ্গে বেয়াদবির ফল তিনি পেয়েছেন— দেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়েছেন।
কুমিল্লা একটি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এলাকা, যা একসময় ছিল সমতটের রাজধানী।
নোয়াখালীবাসীদের বলব— আপনাদের যেহেতু এত বড় জেলা, আপনাদের বিভাগের দরকার নেই; আপনারা রাজধানী চান। বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা থেকে নোয়াখালীতে নিয়ে আসা হোক— আমরা হয়তো সমর্থন করতেও পারি।
কিন্তু কুমিল্লা বিভাগের দাবির বিপক্ষে থাকা অসভ্যতার কাজ, সভ্যতার বিবর্জিত কাজ।
তারপরও বলব— যদি আপনাদের কুমিল্লা বিভাগের ক্ষেত্রে আপত্তি থাকে, তাহলে কুমিল্লাতে আর কোনো প্রশাসনিক কাজে আসবেন না। শিক্ষাবোর্ড থেকে শুরু করে ৩৪টি দপ্তরে আসবেন না।
তাই আসুন—আমরা সবাইকে সবার প্রাপ্য সম্মানটুকু দিই। জনগণকে শ্রদ্ধা করে আমরা এগিয়ে যাই। অনতিবিলম্বে কুমিল্লাকে বিভাগ ঘোষণা করে কুমিল্লাবাসীর প্রতি রাষ্ট্রীয় ঋণ শোধ করার এখনি উপযুক্ত সময়।