আশুরার ফজিলত ও কারবালার তাৎপর্য

ইসলাম ধর্ম জাতীয় দুর্ঘটনা শিক্ষা সারাদেশ

আশুরার ফজিলত ও কারবালার তাৎপর্য

মোহাম্মদ আবদুর রহিমঃ

ইসলামি বর্ষপঞ্জির সূচনালগ্নেই আগমন ঘটে এক মহিমান্বিত মাসের। সেটি হলো মহররম। আর মহররম মাসের দশম দিন ‘আশুরা’ নামে পরিচিত। এটি ইসলামের ইতিহাসে একদিকে যেমন বরকত, রহমত ও বিজয়ের নিদর্শন, অন্যদিকে তেমনি এক হৃদয়বিদারক আত্মত্যাগের স্মারক।

আরবিতে ‘আশারা’ অর্থ ১০। সেখান থেকেই মহররমের ১০ তারিখকে ‘আশুরা’ বলা হয়। এটি শুধু একটি নির্দিষ্ট দিনের নাম নয়—এটি ইতিহাস, শিক্ষা, আদর্শ ও আত্মিক বিপ্লবের এক অনন্য প্রতীক।

আল্লাহ তাআলা এই দিনটিকে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার মাধ্যমে বিশেষ মর্যাদা দান করেছেন। আশুরার দিনই আল্লাহ হজরত আদম (আ.)-কে সৃষ্টি করেন। এই দিনেই তিনি নুহ (আ.)-এর জাহাজকে মহাপ্লাবনের পর নিরাপদে ‘জুদি’ পর্বতে স্থির করেন। হজরত ইব্রাহিম (আ.) এই দিন আগুন থেকে মুক্তি লাভ করেন, ইউনুস (আ.) মাছের পেট থেকে উদ্ধার পান, আইয়ুব (আ.) রোগমুক্ত হন, সুলাইমান (আ.) রাজত্ব ফিরে পান এবং হজরত ঈসা (আ.) জন্মগ্রহণ করেন ও আকাশে উঠিয়ে নেওয়া হয়। এই দিনই ইয়াকুব (আ.) তাঁর বহুদিনের হারানো সন্তান ইউসুফ (আ.)-কে ফিরে পান। আশুরা তাই নবী-রাসুলদের বিজয়, মুক্তি ও করুণার দিন হিসেবেও বিবেচিত।

আশুরার রোজা ইসলামের প্রারম্ভিক যুগ থেকেই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। মক্কাজীবনেও রাসুলুল্লাহ (সা.) আশুরার রোজা রাখতেন এবং তা মুসলমানদের জন্য ফরজ ছিল। কিন্তু হিজরি দ্বিতীয় বর্ষে রমজানের রোজা ফরজ হওয়ার পর আশুরার রোজা নফল হিসেবে রয়ে যায়। তবে নফল রোজার মধ্যে এটি সর্বাধিক ফজিলতপূর্ণ।

হাদিসে এসেছে, আশুরার রোজা এক বছর আগের গুনাহ মোচনের কারণ হয়। (মুসলিম, মুসনাদে আহমাদ) কারবালার শিক্ষা হলো জুলুমের কাছে মাথা নত না করা, সত্যের জন্য দৃঢ় থাকা, অন্যায়ের প্রতিবাদে ভয় না পাওয়া

মদিনায় হিজরতের পর রাসুল (সা.) লক্ষ করেন, ইহুদিরাও আশুরার রোজা রাখে। কারণ, এই দিনেই আল্লাহ তাআলা মুসা (আ.)-কে ফেরাউনের জুলুম থেকে মুক্তি দেন এবং বনি ইসরাইলকে রক্ষা করেন। নবী করিম (সা.) ইহুদিদের অনুসরণের চিহ্ন মুছে দিতে সাহাবায়ে কেরামকে নির্দেশ দেন যেন তাঁরা আশুরার আগের দিন (৯ তারিখ) অথবা পরের দিন (১১ তারিখ) মিলিয়ে দুটি রোজা রাখেন। তিনি বলেন, ‘আমি যদি আগামী বছর বেঁচে থাকি, তবে ৯ তারিখেও রোজা রাখব।’ (মুসলিম)

রাসুল (সা.) আরও বলেন, ‘যে ব্যক্তি আশুরার দিনে তার পরিবারের জন্য ভালো খাবারের ব্যবস্থা করে, আমি আশাবাদী আল্লাহ তাআলা পুরো বছর তার রিজিকে বরকত দেবেন।’ (আবুদাউদ, তিরমিজি)

আশুরা কেবল অতীত নবী-রাসুলদের ঘটনার স্মরণ নয়; এই দিন আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় এক অবিস্মরণীয় আত্মত্যাগ—কারবালার প্রান্তরে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর প্রিয় দৌহিত্র হজরত হোসাইন (রা.)-এর শাহাদাত।

 ৬১ হিজরি, ১০ মহররম, শুক্রবার। ইতিহাসের সেই কালো দিন। মদিনা থেকে কুফাবাসীর আমন্ত্রণে হজরত হোসাইন (রা.) পরিবার-পরিজন নিয়ে রওনা দেন। তাঁরা ইয়াজিদকে খলিফা হিসেবে মানতে রাজি ছিলেন না, কারণ ইয়াজিদের চরিত্র ও শাসনব্যবস্থা ইসলামের আদর্শবিরুদ্ধ ছিল। কুফার হাজারো চিঠির আশ্বাসে হোসাইন (রা.) রওনা হলেও বাস্তবে সেখানে ছিল প্রতারণা ও ষড়যন্ত্র। তাঁকে কুফায় প্রবেশ করতে দেওয়া হয়নি; পরিবারসহ তাঁকে আটকে রাখা হয় কারবালার প্রান্তরে। পানির অধিকারও ছিনিয়ে নেওয়া হয় তাঁদের কাছ থেকে।

এই ভয়াবহ অবরোধ ও নিপীড়নের মধ্যেই ঘটে যায় ইতিহাসের এক মর্মন্তুদ ঘটনা। হোসাইন (রা.)-এর একটি ছোট শিশু তৃষ্ণায় কাতর, নারীরা অশ্রুসিক্ত, সাহচর্যশূন্য তাঁবুতে মৃত্যুর প্রতীক্ষা আর হোসাইন (রা.) নিজে দৃঢ়চিত্তে প্রস্তুত শহীদের পথে। তিনি একে একে পরিবারের সদস্যদের বিদায় জানান আর শেষে নিজেও আল্লাহর পথে আত্মত্যাগ করেন।

কারবালার আত্মত্যাগ শুধু কাঁদার জন্য নয়, এটি শিক্ষা নেওয়ার জন্য। হোসাইন (রা.) তাঁর ভাষণে বলেন, ‘যে শাসক আল্লাহর সীমা লঙ্ঘন করে, সুন্নাহবিরোধী কাজ করে, জুলুম চালায়—তার বিরুদ্ধে যারা রুখে দাঁড়ায় না, তাদের প্রতিও আল্লাহ অসন্তুষ্ট হন।’

কারবালার শিক্ষা হলো জুলুমের কাছে মাথা নত না করা, সত্যের জন্য দৃঢ় থাকা, অন্যায়ের প্রতিবাদে ভয় না পাওয়া। আশুরা আমাদের শেখায় অন্যায় ও স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, সত্য ও ইনসাফ প্রতিষ্ঠার পথে প্রয়োজনে জীবন দিতেও পিছপা না হওয়া।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *