
বিলুপ্তির পথে লাকসামের
ঐতিহ্যবাহী তেলের কল
লাকসাম প্রতিনিধিঃ
ধন-দৌলত ও বাণিজ্যের শহর হিসেবে খ্যাত কুমিল্লার লাকসাম উপজেলার ঐতিহ্যের অবিচ্ছেদ্য অংশ ‘দৌলতগঞ্জ বাজার’। দৌলত এবং গঞ্জ শব্দ দু’টির সমন্বয়ে গঠিত ‘দৌলতগঞ্জ’। প্রচলিত অর্থে ধন-দৌলতে ভরপুর থাকায় এ বাজারের নামকরণ করা হয় ‘দৌলতগঞ্জ’।
লাকসাম দৌলতগঞ্জ বাজারের ঐতিহ্যের অন্যতম আর্থিক ধারক-বাহক ছিলো তৈল কল। একটা সময় সরিষার খৈল মাছের ঘের, পানের বরজ ও বিভিন্ন ক্ষেতে ব্যবহার করা হতো। সে সময় সরিষার তেলের বিকল্প যেন আর কিছুই ছিল না, যা বর্তমানে বিলুপ্তপ্রায়।
জানা যায়, বিংশ শতাব্দীতে লাকসামের এক শ্রেণির মানুষের জীবিকা নির্বাহের অন্যতম মাধ্যম ছিল ‘তেলের মিল বা তেল কল’। তেল, খৈল উৎপাদন ও বিক্রির মাধ্যমে মিলের মালিকরা যেমনি লাভবান হতেন, তেমনিভাবে অর্থ উপার্জনের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করতেন কর্মরত শ্রমিকরাও। ঘানি শিল্পের বিলুপ্তির পর যন্ত্রে চালিত তেল-কলকেই উপার্জনের হাতিয়ার ভাবতেন তারা।
একাত্তর পরবর্তীতে খাতুন অয়েল মিল, বাংলাদেশ অয়েল মিল, সুসেন অয়েল মিল, বলাকা অয়েল মিল, বেগম অয়েল মিল, ডিজি অয়েল মিলসহ প্রায় অর্ধশত তেলের মিল সচল ছিলো দৌলতগঞ্জ বাজারে। আর এতদাঞ্চলের গৃহস্থরা খাঁটি সরিষার তেল শরিরে ব্যবহার, তরি-তরকারিসহ সব ধরণের রান্নার কাজ করতো। এক কথায় সরিষার তেল ছাড়া সে সময় রান্না-বান্নাতে যেন গৃহিনীরা আর অন্যকিছু চিন্তাই করতো না।
লাকসাম দৌলতগঞ্জ বাজারের অভ্যন্তরে ৩৬টির মধ্যে বর্তমানে মেসার্স বাবুল অয়েল মিল, দি নিউ ইউনাইটেড অয়েল মিল, কোহিনুর অয়েল মিল, ন্যাশনাল অয়েল মিল, পুতুল অয়েল মিল, জুবলী অয়েল মিলসহ হাতেগোনা কয়েকটি তেলের মিলের দেখা মেলে।
সরিষার দাম বৃদ্ধি, বাজারে কম দামের ভেজাল তেল, শ্রমিক সংকটসহ নানান সমস্যায় এসব কলগুলো বন্ধ হয়ে বর্তমানে ৫/৬টিতে এসে দাড়িয়েছে।
ভোক্তাদের ভোজ্য তেলের তালিকায় এখন আর সরিষার তেল নেই।
এক সময়ের (আঞ্চলিক ভাষায় ‘ভালা তেল’) খ্যাত সরিষার তেল এখন কেবলই ত্বকের যতেœ নামমাত্র ব্যবহার হচ্ছে। যখন থেকে সরিষার তেলের প্রতি এ অঞ্চলের মানুষদের আসক্তি কমতে শুরু করেছে, তখন থেকেই এক এক করে তেল কলগুলো বন্ধ হচ্ছে মিল মালিকরা জানান, স্বল্পমূল্যের পাম-সয়াবিন তেলে বাজার সয়লাব হওয়ায় এ অঞ্চলের ভোক্তাদের ভোজ্যতেলের তালিকা থেকে বাদ পড়েছে সরিষার তেল।
এক সময়ের নিত্যব্যবহার্য সরিষার তেল এখন ভর্তা, সালাদ, চাটনি, মোরব্বাসহ মুখরোচক কয়েকটি খাবার তৈরিতে বিশেষ উপকরণ হিসেবে ব্যবহার হয়।
আবার কেউ কেউ কেবল ত্বকের যত্নে নামে মাত্র ব্যবহার করে। সরিষার তেলের প্রতি ভোক্তাদের অনাসক্তিকেই মিল বিলুপ্তির মূল কারণ হিসেবে উল্লেখ করেন এখানকার তৈল কল মালিকরা।
সরিষার আবাদ কমে যাওয়ায় এবং সরিষার দাম বেশি হওয়ায় তেলের দামও বেশি। পাশাপাশি অভিজ্ঞ-শ্রমিক সংকটকেও দায়ী করেন তারা।
‘কেমন চলছে মিল ? এমন প্রশ্নের জবাবে মিল মালিকদের সরল উত্তর ‘ছাইড়া দে মা কাইন্দা বাঁচি’।
দৌলতগঞ্জ বাজারের একাধিক মিল মালিকের মতে, বর্তমানের সচল মিলগুলো কেবলই তাদের পূর্বপুরুষদের পেশাগত এতিহ্যের নীরব বাহক। সারা বছর লোকসানের হিসাব গুনে বছর শেষে মোটা অংকের করের বোঝা বহন করতে হয় তাদের। নিজেদের মিলের মালিক দাবী করতেও অনীহা প্রকাশ করেন কয়েকজন।
তাদের বক্তব্য, প্রতিদিন সকাল থেকে রাত অবধি পূর্ব পুরুষের রেখে যাওয়া ঐতিহ্যের পাহারা দিচ্ছেন তারা। বংশানুক্রমে এ পেশার সাথে আগামী প্রজন্মের সংশ্লিষ্টতার বিষয়ে তারা সন্দীহান।
মেসার্স জুবলি অয়েল মিলের মালিক সিরাজুল হক বলেন, একসময়ে লাকসামে ছোট বড় ৩৬টি তৈলের মিল ছিল। যাতে দিবারাত্রি উৎপাদন অব্যাহত থাকতো। বর্তমানে ৫/৬ টি তৈলের মিল আংশিক উৎপাদন চালু রাখলেও তাদেরও চলার গতি জরাজীর্ণ। তৈল কল শিল্প ধ্বংসের পেছনে রয়েছে দোকানিরা অধিক মুনাফার লোভে মানব দেহের জন্য ক্ষতিকর ভেজাল তৈল বিক্রিতে আগ্রহী। আবার এসব ক্ষুদ্র শিল্পগুলো পরিচালনা করতে সরকারের বিভিন্ন দফতর থেকে ৮/১০ টি লাইসেন্স সংগ্রহ এবং তা নবায়ন প্রক্রিয়া অব্যহত রাখতে হয়। যা প্রতিষ্ঠানের মালিকদের জন্য ব্যয়বহুল হয়ে পড়ে।
ব্যাংক ঋনের উচ্চ সুদ, সরিষা আমদানীতে জটিলতা, সিন্ডিকেট কারসাজিসহ নানাহ কারণে তেলের মিলগুলো উৎপাদিত পন্য বাজারজাতে মুখ থুবড়ে পড়েছে। মনে হচ্ছে আমরা অল্প সময়ের মধ্যেই হারিয়ে যাবো।
ঘানি শিল্প ও তেলকল বিলুপ্তির কারণ জানতে চাইলে বাবুল অয়েল মিলের মালিক ছায়ীদুর রহমান বাবুল বলেন, আগে যারা আমাদের মিস্ত্রি ছিলো তারা এখন নিজ গ্রামে গিয়ে লাইসেন্স বিহীন ছোট একটি তেল কল বসিয়ে অঞ্চলভিত্তিক তেল, খৈল বিক্রি করায় আমাদের বেচা-বিক্রি কমে গেছে।
তার উপর এ অঞ্চলে বন্যার প্রবণতা বেড়ে যাওয়ায় মাছের ঘেরের মালিকরা মাছ চাষে অনাগ্রহী হওয়া খৈল তেমন বিক্রি হয়না। তার উপর সরিষার দাম বৃদ্ধিসহ নানান কারণে আমাদের ঐতিহ্যের এই তৈল কলগুলো হারিয়ে যাচ্ছে।